Header Border

ঢাকা, শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল) ২৯.৯৬°সে

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য

প্রতিবেশী মানবসমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো।সমাজে যাঁরা পাশাপাশি বসবাস করেন, তাঁদের প্রতিবেশী বলা হয়।ইসলামের দৃষ্টিতে নিজ ঘর হতে সম্মুখের চল্লিশটি, পশ্চাতের চল্লিশটি, ডান পাশের চল্লিশটি ও বাম পাশের চল্লিশটি যাদের ঘর রয়েছে এরাই প্রতিবেশী।সে আত্মীয়ও হতে পারে আবার অনাত্মীয়ও। মুসলিমও হতে পারে আবার অমুসলিমও। বন্ধুও হতে পারে আবার শত্রুও। পূণ্যবানও হতে পারে আবার পাপীও। উপকারীও হতে পারে আবার হতে পারে ক্ষতি সাধনকারীও।তবে মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও আনন্দ-বেদনায় এ প্রতিবেশী-ই নিত্যসঙ্গী।বিপদে আপদে অতি সহজে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর একমাত্র কাছের লোক হলো প্রতিবেশী।ইসলামে প্রতিবেশীর প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে জোর দেওয়া হয়েছে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনযাপন করা বা আশপাশের মানুষজনের বিরাগভাজন হয়ে সমাজে বসবাস করা ইসলামে নিন্দনীয়।

কিন্তু আজকাল এ বিষয়ে আমাদের মাঝে চরম অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে গ্রামের মানুষের মাঝে।সামান্য কথার কাটাকাটি কিংবা সামান্য এক টুকরো জমির জন্য বছরের পর বছর পার হয় পাশের বাড়ির মানুষের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয় না, খোঁজখবর নেওয়া হয় না। অথচ প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচারণ ও তাকে কষ্ট না দেওয়াকে ঈমানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তাই প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা এবং সমাজবদ্ধ জীবন রাঙানো মুমিনের একান্ত কর্তব্য।

হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে জোর দিয়ে বলেন, ‘হজরত জিবরাইল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাগিদ করেছেন, আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রতিবেশীকে সম্পদের উত্তরাধিকার বানিয়ে দেওয়া হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

প্রতিবেশী চার ধরনের হতে পারে। স্তরভেদে তাদের অধিকারেও কমবেশি হয়।

এক. অনাত্মীয় অমুসলিম প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর যেসব সাধারণ অধিকারের কথা কোরআন-হাদিসে এসেছে, সবই তাঁরা পাবেন। অমুসলিম বলে কোনো ধরনের অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা অনুচিত।

দুই. অনাত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশী, যিনি প্রতিবেশী হওয়ার পাশাপাশি একজন মুসলিম ভাইয়ের প্রতি অন্য মুসলিম ভাইয়ের যেসব দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে, তাও পাবেন।

তিন. আত্মীয় অমুসলিম প্রতিবেশী। এমন ব্যক্তির প্রতিও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ হয়েছে। মহানবী (সা.) অমুসলিম আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর রাখতেন এবং তাঁদের যত্ন নিতেন।

চার. আত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশী। এমন ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি সমাদর পাওয়ার যোগ্য। এদের প্রতি একজন মুমিনের দায়িত্ব-কর্তব্য সবচেয়ে বেশি।

তবে প্রতিটি শ্রেণিই যেহেতু প্রতিবেশী, তাই প্রতিবেশীর সব হকের ক্ষেত্রে সবাই সমান দাবিদার। প্রতিবেশীর খোঁজখবর রাখা, বিপদ-আপদে এগিয়ে আসা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা, উপহার আদানপ্রদান করা, সেবা-শুশ্রূষা করা, কেউ মারা গেলে সান্ত্বনা দেওয়া, একে অন্যের প্রয়োজন পূরণ করা, প্রতিবেশীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, প্রতিবেশীর কষ্ট হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি প্রতিবেশীর হক।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। কোনো কিছুকে তার সঙ্গে শরিক কোরো না এবং পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের দাস-দাসীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৩৬)।

হাদিসে প্রতিবেশীর প্রতি সম্মান ও সদাচরণকে ঈমানের অনুষঙ্গ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আবু শুরাইহ (রা.) বলেন, আমার দুই কান শ্রবণ করেছে, আমার দুই চক্ষু প্রত্যক্ষ করেছে যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং আখেরাতে বিশ্বাস রাখে সে যেন স্বীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করে এবং প্রতিবেশীকে সম্মান করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০১৮)

জীবনযাত্রায় প্রতিবেশীর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিবেশীর হক ও অধিকার ইসলামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের অধিকারের পাশেই প্রতিবেশীর স্থান দেওয়া হয়েছে। কুরআন ও হাদিসে প্রতিবেশীর হক বা অধিকার আদায়ের ব্যাপারে অত্যাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।তাই তাদের প্রতি আমাদের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।

প্রথমত, প্রতিবেশীকে নিরাপদে বসবাস করার অধিকার দিতে হবে। সুতরাং তাকে হাত কিংবা মুখ অথবা অন্য কোন উপায়ে কষ্ট দেয়া যাবে না। হাদিসে এসেছে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ- নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। জিজ্ঞেস করা হল, ‘কোন্ ব্যক্তি? হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, যে লোকের প্রতিবেশী তার হাত থেকে নিরাপদে থাকে না। (বুখারী-৬০১৬, মুসলিম-১৮১ )

দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশী অভুক্ত থাকলে তার খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। সামর্থ্য থাকা সত্তেও যদি প্রতিবেশীর খাদ্যের ব্যবস্থা না করে তাহলে গুনাহগার হতে হবে। হাদিসে এসেছে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ- তিনি বলেন, আমি শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, সে মুমিন নয়, যে ভরপেট খায় অথচ তার পাশে তার প্রতিবেশী অনাহারে থাকে। (বুখারী- ১১২)।

অপর এক হাদিসে আছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) হজরত আবু জর (রা.)-কে বললেন, হে আবু জর, তুমি ঝোল (তরকারি) রান্না করলে তার ঝোল বাড়িয়ে দিয়ো এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক কোরো। (মুসলিম : ২৬২৫)

তৃতীয়ত, কোনো প্রতিবেশী যদি ভুলবশত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো অপরাধ করে ফেলে, তাহলে অবশ্যই সে দোষ গোপন করে প্রতিবেশীর মান-সম্মান রক্ষা করতে হবে।এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেছেন, যদি কোনো মুসলমান ব্যক্তি অপর কোনো মুসলমানের দোষ গোপন করে তাহলে আল্লাহ কেয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির দোষ গোপন করবেন।

চতুর্থত, প্রতিবেশীকে সুখে-দুঃখে সাহায্য-সহযোগিতা করা অপর প্রতিবেশীর নৈতিক দায়িত্ব। বিশেষ করে প্রতিবেশী যখন বিপদে পড়ে যায় তখন তার সাহায্য এগিয়ে যাওয়া উচিত।

পঞ্চমত, প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। যেমন কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, এবং তোমরা আল্লাহরই ইবাদাত কর এবং তাঁর সাথে কোন বিষয়ে অংশীদার স্থাপন করনা; এবং মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার কর এবং আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, দরিদ্র, সম্পর্কবিহীন প্রতিবেশী, পার্শ্ববতী সহচর ও পথিক এবং তোমাদের দাস-দাসীদের সাথেও সদ্ব্যবহার কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী আত্মাভিমানীকে ভালবাসেননা। (সুরা নিসা: ৩৬)

ষষ্ঠত, প্রতিবেশীকে সম্মান করতে হবে। কারণ অপরকে সম্মান করলে নিজে সম্মান লাভ করতে পারে। হাদিসে এসেছে হযরত আবূ শুরায়হ খুযায়ী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ- নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহেমানের খাতির করে। এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, অথবা নীরব থাকে। (মুসলিম ১৮৫)

এছাড়াও প্রতিবেশীর প্রতি আরো কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সেগুলো হলো, প্রতিবেশীর খোঁজখবর রাখা, বিপদ-আপদে এগিয়ে আসা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা, উপহার আদানপ্রদান করা, সেবা-শুশ্রূষা করা, কেউ মারা গেলে সান্ত্বনা দেওয়া, একে অন্যের প্রয়োজন পূরণ করা, প্রতিবেশীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, প্রতিবেশীর কষ্ট হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি প্রতিবেশীর হক।কোনো প্রতিবেশী অসুস্থ হলে দ্রুত তার আরোগ্যের জন্য দোয়া করা এবং সরাসরি তার সেবা-শুশ্রূষা করা । প্রতিবেশীর সাথে দেখা হলে তার সাথে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করা। প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া বিবাদ না করা ইত্যাদি।

সর্বোপরি, প্রতিবেশীর সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য।বিশ্বব্যাপী চলমান এ সংকটপূর্ণ সময়ে আমাদের সবার উচিত প্রতিবেশীদের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা রাখা।তাদের অভাব-অনটনে সাহায্য-সহায়তার হাতকে প্রসারিত করা। তাই আসুন আমরা আমাদের প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে যত্নশীল হই।আল্লাহ আমাদের সবাইকে তওফিক দান করুন।

-মোঃ জয়নুল আবেদীন মল্লিক                                                                                                                              সাংবাদিক ও কলামিষ্ট 

 

আপনার মতামত লিখুন :

আরও পড়ুন

ঈদ জামাত কোথায় কখন
দেশের আকাশে চাঁদ দেখা যায়নি, বৃহস্পতিবার ঈদ
ইসলাম মানবিকতা,উদারতা ও মহানুভবতার ধর্ম
রমজান সংযম শেখায়,নামাজ শেখায় কল্যাণ
উন্নত সমাজ গঠনে সামাজিক সংগঠনের বিকল্প নেই
উন্নত সমাজ গঠনে সামাজিক সংগঠনের বিকল্প নেই

আরও খবর